আমি অনেকটা বাধ্য হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির বক্তব্য খণ্ডন করার প্রয়োজন বোধ করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আইনানুগ মর্যাদা বিষয়ে গত ২৬ জুলাই তাঁর বরাত দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত তাঁর বক্তব্য এবং সাধারণভাবে গত মে মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনের একটি প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ ধরে আমার বক্তব্য হাজির করব।
সরকারের ভ্রম
সংবাদে প্রকাশিত তথ্যমতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য প্রসঙ্গের মধ্যে বলেছেন:
১. সংবিধানে সকল সংখ্যালঘুকে সাধারণভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত করা আছে এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকার তাদের আর শুধু ‘উপজাতি জনগোষ্ঠী’ হিসেবে নয়, ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছে।
২. পনেরো কোটি জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষকে বিশেষ ও উন্নীত পরিচয়ের অধিকার দিতে গিয়ে বাকি ৯৮ দশমিক ২ শতাংশের অধিকার হরণ বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
৩. সুচারুরূপে নথিবদ্ধ করা ভারতীয় উপমহাদেশের এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাস পুনরায় নিশ্চিত করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ষোড়শ থেকে উনিশ শতকের মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশের মোঙ্গল জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে এই অঞ্চলে অভিবাসিত হয়। এখানে তারা আসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসেবে। বংশানুক্রমে বাংলাদেশের আসল অধিবাসী বা প্রথম জাতীয় জনগোষ্ঠী হলো এখানকার জাতিগত বাঙালিরা। তারাই এখন বাংলাদেশের পনেরো কোটি জনসংখ্যার নিরানব্বই শতাংশ।
৪. তিনি জোর দিয়ে বলেন, জাতিগত বাঙালিরা এখানে ঔপনিবেশিক কায়দায় বসত করেনি, এমনকি নিজ ভূখণ্ডে কখনো তারা অ-আদিবাসী বা বিদেশি ছিলও না, হবেও না।
৫. তিনি আরও বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সব ঐতিহাসিক দলিলপত্র এবং ঔপনিবেশিক কালের ভারতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারীদের ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ বা ‘নবাগত বসতকার’ হিসেবেই সরকারিভাবে শনাক্ত করা হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে চাকমা রাজা এবং জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য হিসেবে মন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে আমার অবস্থান নিচে বর্ণিত হলো:
জাতিগত সংখ্যালঘু
মাননীয় মন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এবং ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী থেকে যে সূত্র টেনেছেন, তা সঠিক নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর কোথাও ‘এথনিং মাইনরিটি’ বা বাংলা অনুবাদে ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ শব্দটি বলা নেই। ‘উপজাতি’ বলার পাশাপাশি এই সংশোধনীর নতুন যুক্ত হওয়া ২৩ক অনুচ্ছেদে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ ও ‘ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ে’র কথা বলা হয়েছে মাত্র।
অধিকার ‘প্রদান’ ও ‘হরণ’
মাননীয় মন্ত্রী জাতীয় জনসংখ্যার ১ দশমিক ২ শতাংশের ‘অধিকার প্রদানকে’ বাকি ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ জনগণের অধিকার হরণ বলে যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বেঠিক এবং ভুল বোঝার ফল। বাংলাদেশের বাদ পড়া, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত ১ দশমিক ২ শতাংশ জনগণের আত্মপরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি তাদের প্রান্তিক অবস্থান ঘোচানোয় একটি শক্ত মঞ্চ ও আইনি ভিত্তি জোগাবে। এর দ্বারা এই জনগোষ্ঠী বা তার অন্তর্ভুক্ত কোনো সদস্যের বিশেষ কোনো সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি হবে না। অন্যান্য দেশে, যেমন—নেপাল, ফিলিপাইন, স্ক্যান্ডিনেভীয় ও লাতিন আমেরিকার দেশে আদিবাসীদের অধিকার দিতে গিয়ে অ-আদিবাসীদের বঞ্চিত করতে হয়নি। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় যে কিছু নাগরিককে ‘আদিবাসী’ মর্যাদা দেওয়া মানেই নাগরিকদের একটি অংশ আপনাআপনি প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে।
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও অর্থনৈতিক অভিবাসী
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ও অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, তা একইভাবে বাংলাদেশের বাংলাভাষী কিংবা উর্দুভাষী অন্য নাগরিকদের বেলায়ও প্রযোজ্য হতে পারে (যারা মুসলিম এবং বর্তমান ভারত বা মিয়ানমার থেকে অভিবাসী হয়েছিলেন)। অভিবাসনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ কারণ যা-ই হোক, তা কারও জাতীয় পরিচয় বা নাগরিকত্ব কিংবা নাগরিক অধিকার বা বৈষম্যের শিকার না হওয়ার অধিকারের ভিত্তি হতে পারে না। তা যদি হতো, তা হলে তা হতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে যে বৈষম্যহীনতার নীতিকে শিরোধার্য করা হয়, তার বরখেলাপ এবং পরিপন্থী। একই সঙ্গে তা হতো বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকারী বৈষম্যবিরোধী অনুচ্ছেদগুলোরও বিরুদ্ধে।
বাঙালিরা ‘ঔপনিবেশিক বসতকার’, ‘বিদেশি’ বা ‘অ-আদিবাসী’ নয়
যারা ‘আদিবাসী’ নয় মাননীয় মন্ত্রী তাদের সঙ্গে ‘ঔপনিবেশিক বসতকার’ এবং/অথবা ‘বিদেশি’ পরিচয়কে গুলিয়ে ফেলছেন। কেউ আদিবাসী না হলেই যে ঔপনিবেশিক বসতকার হবে, এটা অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার বেলায় প্রযোজ্য হলেও হতে পারে, বাংলাদেশের বেলায় তা সত্য নয়। সাম্প্রতিক কালের আদিবাসী অধিকারবিষয়ক প্রগতিশীল চিন্তাধারায় যারা আদিবাসী বলে বিবেচিত হয় না, তাদের ‘ঔপনিবেশিক বসতকার’ এবং/অথবা ‘বিদেশি’ বলে ব্যাখ্যা করে না। বাঙালিরা যে বাংলাদেশের স্থানীয় (ন্যাটিভ) জনগোষ্ঠী, অন্য জাতিগোষ্ঠীর আদিবাসী পরিচয় স্বীকার করার মাধ্যমে তা কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ বা অস্বীকৃত হয় না। অ-আদিবাসী মানে ‘বসতকার’ (সেটেলারস) নয়, অন্ততপক্ষে বাংলাদেশ এবং এশিয়ার আরও কিছু দেশে তা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের বেলায় ‘আদিবাসী’ পরিচয় প্রয়োজ্য, কারণ তারা ১. প্রাক-ঔপনিবেশিক ও প্রাক-বিজিত সমাজের উত্তরসূরি এবং ২. অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে তারা প্রাক-ঔপনিবেশিক ও প্রাক-বিজিত পর্যায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অনুগামী রীতি ও প্রথার অনুসারী।
সরকার সম্ভবত ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টির গত শতকের গোড়ার দিকের অর্থের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে সময় এই শব্দের ব্যঞ্জনা কেবল আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের অবস্থাকেই বোঝাত। কিন্তু জাতিসংঘে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পরিমণ্ডলে, উন্নয়নের ধারণায়, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে বোঝাপড়া অনেক দূর এগিয়েছে। আগে যাদের ‘উপজাতি’ বলে বিবেচনা করা হতো, তাদের এখন ‘আদিবাসী’ ধারণার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যে ভুল ধারণাবশত ‘উপজাতি’ ও ‘আদিবাসী’র মধ্যে বেঠিক ও কৃত্রিম পার্থক্য করা হয়, তা আজকের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চিন্তাধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের যেসব নাগরিক নিজেদের ‘আদিবাসী’ বলে পরিচিত করে, তাদের ওপর ‘আদিবাসী’ ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় চাপিয়ে দিলে সেই কাজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবাদী প্রক্রিয়া ও পন্থার বাইরে চলে যাবে।
‘জাতিগত সংখ্যালঘু’, ‘নবাগত বসতকার’দের ‘উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ
মাননীয় মন্ত্রীর তরফে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘নবাগত বসতকার’ বলা এবং তাদের ‘উপজাতীয় জনগোষ্ঠী’ বলে অভিহিত করাও সঠিক নয়।
যেমন ধরা যাক চাকমা জনগোষ্ঠীর কথা। ইতিহাসে নথিবদ্ধ আছে যে, তারা যে দেশে বাস করত তার নাম ‘চাকোমা’। পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ও ভূগোলবিদদের জবানি থেকে জানা যায়, তাদের এই দেশ আজকের বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে কমপক্ষে ১৫৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা আরাকান ও ত্রিপুরা থেকে আলাদা ছিল। হয়তো ওই তারিখের এক শ বছর আগেও তারা আজ যেখানে বাস করে সেখানেই বাস করে থাকতে পারে, যেমন থাকতে পারে ওই অঞ্চল এবং বাংলাদেশের অন্যত্র বসবাসকারী অন্য আদিবাসীরাও। বাঙালিরা পাবর্ত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯ শতকের আগে স্থায়ীভাবে বাস করত বলে জানা যায় না। বাংলার কোথাও আদিবাসীরা বাঙালিদের উচ্ছেদ করে বসতি গেড়েছে বলেও কোনো প্রমাণ নেই। আদিবাসীরা যেখানে যখনই বসতি স্থাপন করা শুরু করুক না কেন, তাদের বসতি স্থাপনের সময় সেসব অঞ্চল বাঙালি-অধ্যুষিত ছিল না। বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সনদের ১০৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে পরিগণিত হতে হলে তাদের সহস্র বছর ধরে কোথাও বসবাস করার প্রয়োজন নেই—যেমনটা প্রযোজ্য আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার বেলায়। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী, ‘উপনিবেশায়ন বা দখলাধীন হওয়ার সময়’ (যেমন আঠারো বা উনিশ শতক) সেখানে তাদের বসতি থাকা এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অনুগামী রীতি ও প্রথার অনুসারী হওয়াই ‘আদিবাসী’ বলে গণ্য হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। বাংলাদেশের আদিবাসীদের অবস্থান সেই শর্তের সঙ্গে মানানসই।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে, ব্রিটিশ আমলের কিছু আইনে এবং পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পরে আদিবাসী জনগণকে ‘ট্রাইবাল’ বা ‘উপজাতি’ বলে গণ্য করা হয়। তাহলেও, ‘ট্রাইবাল’, ‘ইনডিজিনাস’ (আদিবাসী) অথবা ‘অ্যাবরিজিনাল’ (প্রাচীন অধিবাসী) শব্দগুলো পরস্পরের বদলাবদলি সমার্থক ধারণা হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার নজির রয়েছে। এমন কিছু নজিরের দিকে নজর দেওয়া যাক: যেমন ‘অ্যাবরিজিনাল’ শব্দটি ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যাসি অ্যাক্ট-এ লিপিবদ্ধ আছে। (আইনটি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম তফসিল দ্বারা সুরক্ষিত।)
সিএইচটি রেগুলেশন, ১৯৯০; ফাইন্যান্স অ্যাক্টস অব ১৯৯৫ অ্যান্ড ২০১০; পভার্টি রিডাকশন স্ট্র্যাটেজি (পিআরএসপি-২০০৮, ২০০৯-২০১০), সম্প্রতি চাকমা বনাম কাস্টমস কমিশনার ও অন্যদের মামলায় মহামান্য আদালতের রায়ে (5 BLC, AD, 29) ‘ইনডিজিনাস’ শব্দটি আদিবাসী অর্থে ব্যবহূত হয়েছে।
আদিবাসী দিবসে মাননীয় সরকারপ্রধান থাকাকালে শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া এবং ড. ফখরুদ্দীন আহমদের শুভেচ্ছাবার্তায় ‘আদিবাসী’ শব্দের উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া সরকারি দলিল পিআরএসপিতে, সরকারি আইন স্মল এথনিং গ্রুপস কারচারাল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট, ২০১০-এও তো আদিবাসী ধারণার স্বীকৃতি রয়েছে।
২৭ জুলাই ২০১১
দেবাশীষ রায়: চাকমা রাজা এবং জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য।