Written on Saturday, March 12, 2011 at 12:55pm
দেড়শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জাপানে। ভূকম্পন আর সুনামিতে নিহতের সংখ্যা দেড় হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। পরমাণু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোথাও আগুন জ্বলছে, কোনো শহর এখনো রয়েছে পানির নিচে। পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত।
শুক্রবার দুপুরে ৮ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার পরপরই ১০ মিটার উচ্চতার সুনামিতে ভেসে যায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এ দেশের উত্তর-পূর্ব উপকূল। ভূমিকম্প ও সুনামির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জাপানের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়।
শনিবার দিনের আলো ফুটতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংসের চিত্র প্রকাশ হতে শুরু করে। জাপানের সংবাদ সংস্থা 'কিয়োদো' ভূমিকম্প ও সুনামিতে নিহতের সংখ্যা অন্তত ১৩০০ বলে জানিয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরো অনেকে। ফলে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর কয়েকটি পরাঘাতে পুনরায় কেঁপে ওঠে জাপান। এতে মানুষের মধ্যে আবার আতঙ্ক দেখা দেয়।
সুনামির সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে উপকূলীয় নগরী সেন্দাইয়ে, যেখানে ১০ লাখ লোকের বাস। জাপানের সরকারি টেলিভিশন এনএইচকের স¤প্রচারে দেখা যায়, সাগর থেকে উঠে আসা বিশাল ঢেউ ভাসিয়ে নিচ্ছে গাড়ি, জাহাজ, ঘর-বাড়ি।
কিয়োদো নিউজ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের পর সেন্দাইয়ের বিমানবন্দরে আগুন ধরে গেলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এনএইচকে টেলিভিশনের এক সাংবাদিক জানান, সেন্দাই শহরের অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। অনেকে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়ে উদ্ধারের অপেক্ষায় রয়েছে। পানির
সংবাদ সংস্থা জিজি নিউজ জানিয়েছে, উত্তর উপকূলের প্রায় পৌনে ১ লাখ লোকের শহর কেসেনুমার এক-তৃতীয়াংশ এলাকা রয়েছে পানির নিচে। শহরবাসীর অনেকেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে অন্য স্থানে পাড়ি জমিয়েছে।
রাজধানী টোকিও-ও ভূমিকম্পের আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি। ভূমিকম্পের পরপরই সেখানে গণপরিবহণ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাতাল রেলপথ শনিবার খুলে দেওয়া হলেও পরাঘাতের কারণে ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি।
একটি স্টেশনে অপেক্ষমান এক নারী রয়টার্সকে বলেন, "যেভাবে কম্পন হচ্ছে, তাতে আমার দাঁড়িয়ে থাকাই দায়।"
ভূমিকম্পের পরপরই সব সমুদ্রবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়, বন্ধ রয়েছে অনেকগুলো বিমানবন্দরও। গাড়ির তৈরির কারখানাগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কিয়োদো বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, অন্তত ১০০ আরোহীসহ একটি জাহাজ সুনামিতে ভেসে গেছে। একটি ট্রেনের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
ভূমিকম্প সবচেয়ে বড় শঙ্কা তৈরি করেছে তেজষ্ক্রিয়তার। টোকিও থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরের ফুকোশিমা পরমাণু স্থাপনা থেকে সামান্য মাত্রায় তেজষ্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান ওই স্থাপনার চার দিকের ১০ কিলোমিটার এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
জাপানের এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায়তার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এগিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, তার দেশ সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। প্রতিবেশী দেশ চীন বলেছে, তারাও তৈরি আছে। জাপান বললেই সাড়া দেবে তারা।
ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র পাওয়া না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জাপান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শিলা স্মিথ বলেন, "জাপানের এ দুর্যোগ মোকাবেলায় নজিরবিহীন মানবিক ও ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে হবে।"
প্রধানমন্ত্রী কান শুক্রবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "ভূমিকম্পে জাপানের বিশাল এলাকা জুড়ে বিশেষ করে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে।"
যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর দুইটা ৪৬ মিনিটে শুরু হয়ে পরপর কয়েকবারের ভূমিকম্পে কেঁেপ ওঠে রাজধানী টোকিও। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিলো টোকিওর ২৫০ মাইল দূরে ভূ-পৃষ্ঠের ২০ মাইল গভীরে।
ভূমিকম্পের পরপরই প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া ও রাশিয়াসহ মোট ৫৩টি দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। বেশ কিছু এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় অধিবাসীদের।
জাপানে এর আগে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিলো ১৯২৩ সালে, ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিলো ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ।
১৯৯৫ সালে কোবে নগরীতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য ধরা হয় ১০ হাজার কোটি ডলার। ২০০৪ সালে প্রলয়ঙ্করী সুনামিতে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য ছিলো ১ হাজার কোটি ডলার।
আগ্নেয় পর্বতের উদ্গীরন ও ভূ-পৃষ্ঠের চোরা গতিবিধির কারণে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প। শক্তিশালী ভূমিকম্প থেকে যে জলকম্পের সৃষ্টি হয় তা থেকেই সুনামির উৎপত্তি।'সুনামি' জাপানি শব্দ। এর বঙ্গানুবাদ পোতাশ্রয়ী তরঙ্গ। সু-মানে পোতাশ্রয়, নামি হলো তরঙ্গ। টাইভাল ওয়েভস্ বা জোয়ারে তরঙ্গ বলেই মানুষ একে চেনে। ভূমিকম্প বা জোয়ারের প্রভাব ছাড়াও অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস বা মহাজাগতিক বস্তু পতনেও সুনামি হতে পারে। প্রকৃতির খামখেয়ালির ঝাপট-দাপট বিষাক্ত ছোবলের আর এক নাম সুনামি। সাইক্লোন, টাইফুন, হ্যারিকেনের ক্ষেত্রে প্রতি দশ সেকেন্ড অন্তর সমুদ্রে ১৫০ মি. পর্যন্ত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ঢেউ সৃষ্টি হয়, আর সুনামি বৃত্তাকারে প্রতি সেকেন্ডে ২০০ মি. কিংবা ঘণ্টায় ৭০০ কি.মি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। উৎপত্তিস্থল থেকে ১০ হাজার কি.মি দূরেও এর দানবীয় তাণ্ডব অব্যাহত থাকে।
প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর খণ্ডটিই সুনামির মুক্তাঞ্চল। দক্ষিণ চীন সাগরেও সুনামির উদ্ভব হয়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিনস সংলগ্ন সমুদ্রতল অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির কারণে এলাকাটি ভূমিকম্পপ্রবণ। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাছে ৩৮,৬০০ কি.মি লম্বা ঘে রিং অব ফায়ার বা অগি্নবলয় রয়েছে, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভূকম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে তা চিহ্নিত। হাওয়াইয়ের কাছে হিলো শহরকে সুনামি সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে।
অগ্ন্যুৎপাত, ভূকম্প, সুনামি সামুদ্রিক ঝড়, বন্যা ইত্যাকার প্রাণঘাতী সম্পত্তি ধ্বংসী সভ্যতা বিনষ্টি প্রকৃতির হামলায় ৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ায়, ১২২৮ সালে হল্যান্ডে, ১২৯০ সালে চীনের চেহলিতে, ১৬৪২ সালে চীনে, ১৭০৩ সালে জাপানের আওয়া দ্বীপে, ১৭৩৬ সালে জাপানের হোক্কাইডো শহরে, ১৭৩৭ সালে ভারতের কলকাতায়, ১৭৭৫ সালে পর্তুগাল-লিসবনে, ১৭৭৯ সালে ভিসুভিয়াসের পাদদেশের পম্পেই ও হার কুলোনিয়াম শহরে, ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকতোয়া আগ্নেয়গিরির পর পর চারবার বিস্ফোরণে সুন্দা ও সুমাত্রায়, ১৮৮৭ সালে চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদীর বন্যায়, ১৮৯৭ সালে ভারতের শিলং-এ, ১৯২০ সালে চীনের গাঞ্জসুতে, ১৯২৭ সালে চীনে, ১৯৩১ সালে চীনের হোয়াংহো নদীর বন্যায়, ১৯৩৯ সালে উত্তর চীনে, ১৯৪৬ সালে আলাস্কার ন্যালিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, ১৯৫২ সালে রাশিয়ার বামসার্কায়, ১৯৬০ সালে চিলি ও হাওয়াইদ্বীপে, ১৯৬৪ সালে আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে ও আমেরিকা কানাডা হাওয়াইতে, ১৯৬৬ সালে পেরুতে ও হাওয়াইতে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে, ১৯৭৫ সালে হাওয়াইদ্বীপে, ১৯৭৬ সালে চীনে, ১৯৭৭ সালে সুমাত্রায়, ১৯৯৩ সালে লাটুর ভূমিকম্পে, ১৯৯৪ সালে মিনডোবার ফিলিপিনস দ্বীপে, সম্প্রতি ভারতের গুজরাটে এবং সর্বশেষ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে লাখ লাখ প্রাণ বিনাশ হয়েছে। কত পশুপাখি সামুদ্রিক জীব মরছে, কত কৃষ্টি, কত সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে, কত শস্য, কত ফসল বিনষ্ট হয়েছে, কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছে প্রকৃতি_ তার কোন ইয়ত্তা নেই।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় সকাল ৬টা ২৮ মিনিটে সুমাত্রা দ্বীপের ২৫০ কি.মি দক্ষিণ-পূর্বে সমুদ্রতলের ৪০ কি.মি গভীরে প্রবল ভূকম্পনজনিত আলোড়নে (রিখটার স্কেলে তীব্রতা ৮.৯) দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভারত (আন্দামান ও নিকোবর, দ্বীপপুঞ্জ, তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্র, ওড়িশা, পণ্ডিচেরী) বাংলাদেশে পাহাড় হয়ে আসা ভয়াবহ যে জলকম্প সৃষ্টি হয়, তাই সুনামি। প্রায় ২ লাখের বেশি মানুষ, অজস্ত্র পশু-পাখি, জলজপ্রাণী (আগে-ভাগে জানতে পারে বলে কুকুর ইত্যাদি অনেক প্রাণী নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়), বহুমূল্যের বনজ-খনিজসম্পদ ও ফসলসহ কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ এবং ঐতিহাসিক সভ্যতা সৃষ্টি সুনামির দাঁতালো আক্রমণে প্রাণনাশ, বিধ্বংসী ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভূমধ্যসাগরে কাস্পিয়ান সাগরে যেতে হিমালয় সনি্নহিত ভারত, নেপাল এবং বঙ্গোপসাগরজুড়ে একটা বিশাল অঞ্চল কম্পনপ্রবণ। বলেশ্বর গোলাপপুর দীঘা ডায়মন্ডহারবারে প্রবল ভূকম্প জলকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন স্পেনের ক্যানারি আইল্যান্ডসের লা পালমা দ্বীপের কাছে রয়েছে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির অবস্থান। এর একদিকে ইংল্যান্ড, অন্যদিকে আফ্রিকা উভয়ের দূরত্ব মাত্র ২০০ কি.মি। এই আগ্নেয়গিরি নড়েচড়ে বসলে ঘণ্টায় ৭০০ কি.মি. বেগে সমুদ্রদানব সুনামির কাল তরঙ্গের ছোবলে আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার কিছু অংশ লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে। সেটি হবে সর্ববৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞ। বৈজ্ঞানিক সৌকর্ষে সমুদ্রের তাপ ধরে রাখতে পারলে রাক্ষুসে দারুন ঢেউ আটকানো সম্ভব হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
সুনামির সাম্প্রতিক হামলা অঙ্কের উপর পৃথিবীর গড় উত্তর মেরুর অবস্থান প্রায় আড়াই সেন্টিমিটার স্থানান্তর হয়, সুমাত্রার দক্ষিণ- পশ্চিম দিকে ২০-২৫ ফুট সরে গেছে, পৃথিবীর ঘুর্ণনের উপর প্রভাব ফেলে দিনের মেয়াদ কমিয়েছে ২.৬৮ মাইক্রো সেকেন্ড, পৃথিবীর আকার এক হাজার কোটির এক অংশ চ্যাপ্টা হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত।
দেড়শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জাপানে। ভূকম্পন আর সুনামিতে নিহতের সংখ্যা দেড় হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। পরমাণু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোথাও আগুন জ্বলছে, কোনো শহর এখনো রয়েছে পানির নিচে। পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত।
শুক্রবার দুপুরে ৮ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার পরপরই ১০ মিটার উচ্চতার সুনামিতে ভেসে যায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এ দেশের উত্তর-পূর্ব উপকূল। ভূমিকম্প ও সুনামির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জাপানের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়।
শনিবার দিনের আলো ফুটতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংসের চিত্র প্রকাশ হতে শুরু করে। জাপানের সংবাদ সংস্থা 'কিয়োদো' ভূমিকম্প ও সুনামিতে নিহতের সংখ্যা অন্তত ১৩০০ বলে জানিয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরো অনেকে। ফলে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর কয়েকটি পরাঘাতে পুনরায় কেঁপে ওঠে জাপান। এতে মানুষের মধ্যে আবার আতঙ্ক দেখা দেয়।
সুনামির সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে উপকূলীয় নগরী সেন্দাইয়ে, যেখানে ১০ লাখ লোকের বাস। জাপানের সরকারি টেলিভিশন এনএইচকের স¤প্রচারে দেখা যায়, সাগর থেকে উঠে আসা বিশাল ঢেউ ভাসিয়ে নিচ্ছে গাড়ি, জাহাজ, ঘর-বাড়ি।
কিয়োদো নিউজ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের পর সেন্দাইয়ের বিমানবন্দরে আগুন ধরে গেলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এনএইচকে টেলিভিশনের এক সাংবাদিক জানান, সেন্দাই শহরের অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে। অনেকে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়ে উদ্ধারের অপেক্ষায় রয়েছে। পানির
সংবাদ সংস্থা জিজি নিউজ জানিয়েছে, উত্তর উপকূলের প্রায় পৌনে ১ লাখ লোকের শহর কেসেনুমার এক-তৃতীয়াংশ এলাকা রয়েছে পানির নিচে। শহরবাসীর অনেকেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে অন্য স্থানে পাড়ি জমিয়েছে।
রাজধানী টোকিও-ও ভূমিকম্পের আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি। ভূমিকম্পের পরপরই সেখানে গণপরিবহণ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাতাল রেলপথ শনিবার খুলে দেওয়া হলেও পরাঘাতের কারণে ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি।
একটি স্টেশনে অপেক্ষমান এক নারী রয়টার্সকে বলেন, "যেভাবে কম্পন হচ্ছে, তাতে আমার দাঁড়িয়ে থাকাই দায়।"
ভূমিকম্পের পরপরই সব সমুদ্রবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়, বন্ধ রয়েছে অনেকগুলো বিমানবন্দরও। গাড়ির তৈরির কারখানাগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কিয়োদো বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, অন্তত ১০০ আরোহীসহ একটি জাহাজ সুনামিতে ভেসে গেছে। একটি ট্রেনের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
ভূমিকম্প সবচেয়ে বড় শঙ্কা তৈরি করেছে তেজষ্ক্রিয়তার। টোকিও থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরের ফুকোশিমা পরমাণু স্থাপনা থেকে সামান্য মাত্রায় তেজষ্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী নাওতো কান ওই স্থাপনার চার দিকের ১০ কিলোমিটার এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
জাপানের এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায়তার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এগিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, তার দেশ সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। প্রতিবেশী দেশ চীন বলেছে, তারাও তৈরি আছে। জাপান বললেই সাড়া দেবে তারা।
ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র পাওয়া না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জাপান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শিলা স্মিথ বলেন, "জাপানের এ দুর্যোগ মোকাবেলায় নজিরবিহীন মানবিক ও ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে হবে।"
প্রধানমন্ত্রী কান শুক্রবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "ভূমিকম্পে জাপানের বিশাল এলাকা জুড়ে বিশেষ করে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে।"
যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর দুইটা ৪৬ মিনিটে শুরু হয়ে পরপর কয়েকবারের ভূমিকম্পে কেঁেপ ওঠে রাজধানী টোকিও। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিলো টোকিওর ২৫০ মাইল দূরে ভূ-পৃষ্ঠের ২০ মাইল গভীরে।
ভূমিকম্পের পরপরই প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া ও রাশিয়াসহ মোট ৫৩টি দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। বেশ কিছু এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় অধিবাসীদের।
জাপানে এর আগে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিলো ১৯২৩ সালে, ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিলো ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ।
১৯৯৫ সালে কোবে নগরীতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য ধরা হয় ১০ হাজার কোটি ডলার। ২০০৪ সালে প্রলয়ঙ্করী সুনামিতে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য ছিলো ১ হাজার কোটি ডলার।
আগ্নেয় পর্বতের উদ্গীরন ও ভূ-পৃষ্ঠের চোরা গতিবিধির কারণে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প। শক্তিশালী ভূমিকম্প থেকে যে জলকম্পের সৃষ্টি হয় তা থেকেই সুনামির উৎপত্তি।'সুনামি' জাপানি শব্দ। এর বঙ্গানুবাদ পোতাশ্রয়ী তরঙ্গ। সু-মানে পোতাশ্রয়, নামি হলো তরঙ্গ। টাইভাল ওয়েভস্ বা জোয়ারে তরঙ্গ বলেই মানুষ একে চেনে। ভূমিকম্প বা জোয়ারের প্রভাব ছাড়াও অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস বা মহাজাগতিক বস্তু পতনেও সুনামি হতে পারে। প্রকৃতির খামখেয়ালির ঝাপট-দাপট বিষাক্ত ছোবলের আর এক নাম সুনামি। সাইক্লোন, টাইফুন, হ্যারিকেনের ক্ষেত্রে প্রতি দশ সেকেন্ড অন্তর সমুদ্রে ১৫০ মি. পর্যন্ত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ঢেউ সৃষ্টি হয়, আর সুনামি বৃত্তাকারে প্রতি সেকেন্ডে ২০০ মি. কিংবা ঘণ্টায় ৭০০ কি.মি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। উৎপত্তিস্থল থেকে ১০ হাজার কি.মি দূরেও এর দানবীয় তাণ্ডব অব্যাহত থাকে।
প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর খণ্ডটিই সুনামির মুক্তাঞ্চল। দক্ষিণ চীন সাগরেও সুনামির উদ্ভব হয়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিনস সংলগ্ন সমুদ্রতল অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির কারণে এলাকাটি ভূমিকম্পপ্রবণ। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাছে ৩৮,৬০০ কি.মি লম্বা ঘে রিং অব ফায়ার বা অগি্নবলয় রয়েছে, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভূকম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে তা চিহ্নিত। হাওয়াইয়ের কাছে হিলো শহরকে সুনামি সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে।
অগ্ন্যুৎপাত, ভূকম্প, সুনামি সামুদ্রিক ঝড়, বন্যা ইত্যাকার প্রাণঘাতী সম্পত্তি ধ্বংসী সভ্যতা বিনষ্টি প্রকৃতির হামলায় ৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ায়, ১২২৮ সালে হল্যান্ডে, ১২৯০ সালে চীনের চেহলিতে, ১৬৪২ সালে চীনে, ১৭০৩ সালে জাপানের আওয়া দ্বীপে, ১৭৩৬ সালে জাপানের হোক্কাইডো শহরে, ১৭৩৭ সালে ভারতের কলকাতায়, ১৭৭৫ সালে পর্তুগাল-লিসবনে, ১৭৭৯ সালে ভিসুভিয়াসের পাদদেশের পম্পেই ও হার কুলোনিয়াম শহরে, ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকতোয়া আগ্নেয়গিরির পর পর চারবার বিস্ফোরণে সুন্দা ও সুমাত্রায়, ১৮৮৭ সালে চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদীর বন্যায়, ১৮৯৭ সালে ভারতের শিলং-এ, ১৯২০ সালে চীনের গাঞ্জসুতে, ১৯২৭ সালে চীনে, ১৯৩১ সালে চীনের হোয়াংহো নদীর বন্যায়, ১৯৩৯ সালে উত্তর চীনে, ১৯৪৬ সালে আলাস্কার ন্যালিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, ১৯৫২ সালে রাশিয়ার বামসার্কায়, ১৯৬০ সালে চিলি ও হাওয়াইদ্বীপে, ১৯৬৪ সালে আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে ও আমেরিকা কানাডা হাওয়াইতে, ১৯৬৬ সালে পেরুতে ও হাওয়াইতে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে, ১৯৭৫ সালে হাওয়াইদ্বীপে, ১৯৭৬ সালে চীনে, ১৯৭৭ সালে সুমাত্রায়, ১৯৯৩ সালে লাটুর ভূমিকম্পে, ১৯৯৪ সালে মিনডোবার ফিলিপিনস দ্বীপে, সম্প্রতি ভারতের গুজরাটে এবং সর্বশেষ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে লাখ লাখ প্রাণ বিনাশ হয়েছে। কত পশুপাখি সামুদ্রিক জীব মরছে, কত কৃষ্টি, কত সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে, কত শস্য, কত ফসল বিনষ্ট হয়েছে, কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছে প্রকৃতি_ তার কোন ইয়ত্তা নেই।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় সকাল ৬টা ২৮ মিনিটে সুমাত্রা দ্বীপের ২৫০ কি.মি দক্ষিণ-পূর্বে সমুদ্রতলের ৪০ কি.মি গভীরে প্রবল ভূকম্পনজনিত আলোড়নে (রিখটার স্কেলে তীব্রতা ৮.৯) দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভারত (আন্দামান ও নিকোবর, দ্বীপপুঞ্জ, তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্র, ওড়িশা, পণ্ডিচেরী) বাংলাদেশে পাহাড় হয়ে আসা ভয়াবহ যে জলকম্প সৃষ্টি হয়, তাই সুনামি। প্রায় ২ লাখের বেশি মানুষ, অজস্ত্র পশু-পাখি, জলজপ্রাণী (আগে-ভাগে জানতে পারে বলে কুকুর ইত্যাদি অনেক প্রাণী নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়), বহুমূল্যের বনজ-খনিজসম্পদ ও ফসলসহ কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ এবং ঐতিহাসিক সভ্যতা সৃষ্টি সুনামির দাঁতালো আক্রমণে প্রাণনাশ, বিধ্বংসী ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভূমধ্যসাগরে কাস্পিয়ান সাগরে যেতে হিমালয় সনি্নহিত ভারত, নেপাল এবং বঙ্গোপসাগরজুড়ে একটা বিশাল অঞ্চল কম্পনপ্রবণ। বলেশ্বর গোলাপপুর দীঘা ডায়মন্ডহারবারে প্রবল ভূকম্প জলকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন স্পেনের ক্যানারি আইল্যান্ডসের লা পালমা দ্বীপের কাছে রয়েছে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির অবস্থান। এর একদিকে ইংল্যান্ড, অন্যদিকে আফ্রিকা উভয়ের দূরত্ব মাত্র ২০০ কি.মি। এই আগ্নেয়গিরি নড়েচড়ে বসলে ঘণ্টায় ৭০০ কি.মি. বেগে সমুদ্রদানব সুনামির কাল তরঙ্গের ছোবলে আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার কিছু অংশ লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে। সেটি হবে সর্ববৃহৎ ধ্বংসযজ্ঞ। বৈজ্ঞানিক সৌকর্ষে সমুদ্রের তাপ ধরে রাখতে পারলে রাক্ষুসে দারুন ঢেউ আটকানো সম্ভব হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
সুনামির সাম্প্রতিক হামলা অঙ্কের উপর পৃথিবীর গড় উত্তর মেরুর অবস্থান প্রায় আড়াই সেন্টিমিটার স্থানান্তর হয়, সুমাত্রার দক্ষিণ- পশ্চিম দিকে ২০-২৫ ফুট সরে গেছে, পৃথিবীর ঘুর্ণনের উপর প্রভাব ফেলে দিনের মেয়াদ কমিয়েছে ২.৬৮ মাইক্রো সেকেন্ড, পৃথিবীর আকার এক হাজার কোটির এক অংশ চ্যাপ্টা হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত।