খনা এই নামটি নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি।
কিংবদন্তীর কথা
তাকে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনী। এদের সাধারণ সুতোটি হচ্ছে, উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী (Avanti) তথা উজ্জয়নের (Ujjain) রাজা হর্ষ-বিক্রমাদিত্যের (Harsha Vikramaditya) রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহির (Varahamihira), আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কথা। বরাহমিহিরের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে তিনি পুত্রের কোষ্ঠি (horoscope) বিচার করে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান। হিসেব করে দেখেন মাত্র এক বছরের মধ্যেই মারা যাবে তার প্রিয় শিশুপুত্র। পিতা হয়ে পুত্রের মৃত্যু অসহায়ের মত অবলোকন করতে হবে আর ভয়ংকর দিনগুলি গণনা করে যেতে হবে, এই চিন্তা সহ্য করতে না পরে তিনি ভাসিয়ে দেন পুত্রকে, পাত্রে ভরে নদীর স্রোতে।
অনেক দূরের এক রাজ্যে, নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে রাক্ষস সম্প্রদায়। কিন্তু মারা যায় না শিশু, বড় হতে থাকে রাক্ষসদের মধ্যে। ষোল বছর বয়সে শাণিত বুদ্ধির এক রাক্ষস মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে, বিয়ে করে তাকে। মেয়েটি তার জ্যোতির্জ্ঞান প্রয়োগ করে জানতে পারে তার স্বামী মিহির উজ্জয়নের বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র। একদিন দুজন মিলে রওয়ানা দেয় উজ্জয়নের পথে।
পুত্র-পুত্রবধুর পরিচয় পেয়ে রাজপ্রাসাদে তাদের গ্রহণ করেন বরাহ। কৃষিকাজে মেয়েটির ছিল অগাধ জ্ঞান আর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমৎকার পূর্বাভাস দিতে পারত সে। উজ্জয়নের কৃষকরা ব্যাপক উপকার লাভ করে তার কাছ থেকে, আর তা দেখে রাজা বিক্রমাদিত্য মেয়েটিকে তার রাজ্যের দশম রত্ন (tenth jewel) হিসেবে আখ্য দেন।
মেয়েটির জ্ঞানে সারা রাজ্য রাজপ্রাসাদ মুগ্ধ হয়ে রইল, পন্ডিত বরাহের খোঁজ আর কেউ নেয় না। এমনকি বরাহ নিজেও জনসমক্ষে এক বিতর্কে পুত্রবধুর হাতে পরাস্ত হন। ঈর্ষাপরায়ণ বরাহ তাই এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পুত্রকে আদেশ দেন মেয়েটির জিহ্বা কেটে ফেলতে যাতে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় তার কন্ঠ। আর ঘটেও যায় এই মর্মন্তুদ ঘটনা!
উড়িষ্যার উপাখ্যানটিতে বর্ণিত আছে, রক্তক্ষয়ী এই ঘটনার পর মেয়েটির নাম হয় খনা, উড়িয়া ভাষায় যার মানে "বোবা"।
কিন্তু এই কিংবদন্তি কাহিনী সত্য কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, বিক্রমাদিত্যের শাসনামলে বরাহমিহির একজনই ছিলেন। তবে খনার বচনগুলোর অধিকাংশ লিখিত হয়েছে বাংলায়। বচনগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, এগুলোর রচনাকাল ৪০০ বছর আগের নয়। কিন্তু বরাহমিহিরের আবির্ভাবকাল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে! বরাহমিহিরের জাতক প্রভৃতি জ্যোতিষ গ্রন্থের সঙ্গে খনার বচনের কতগুলো অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। কৃষিসংক্রান্ত নানা বিষয় সম্পর্কে খনার বচনগুলো অমূল্য সম্পদ এবং কৃষিজীবীদের কাছে খুবই আদরণীয়।
কথিত আছে তার আসল নাম লীলাবতী জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারীর যিনি বচন রচনার জন্যেই বেশি সমাদৃত, মূলত খনার ভবিষ্যতবাণীগুলোই খনার বচন নামে বহুল পরিচিত। মনে করা হয় ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার আবির্ভাব হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিস পরগনা জেলার বারাসাতের দেউলিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম ছিন অনাচার্য। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে তিনি ছিলেন সিংহলরাজের কন্যা।
বাংলার এক কিংবদন্তীতে আছে, জন্মের পর মেয়েটির পিতা তার নাম রাখেন খনা কারণ তার জন্ম হয়েছিল এক শুভক্ষণে। কিন্তু বাংলার এই মেয়েটি বেড়ে উঠে লঙ্কা নামের রাক্ষস দ্বীপে (বর্তমানের Sri Lanka)। মধ্যযুগীয় কিছু বর্ণনায়, যেমন কালহানের রত্নরঙ্গিনীতে, বাংলার গৌড় (Gauda) কেই অবশ্য রাক্ষস রাজ্য (Kingdom of Demons) হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
খনার বচন
সকাল শোয় সকাল ওঠে
সকাল শোয় সকাল ওঠে
তার কড়ি না বৈদ্য লুটে
আলো হাওয়া বেঁধো না
আলো হাওয়া বেঁধো না
রোগে ভোগে মরো না।
যে চাষা খায় পেট ভরে
যে চাষা খায় পেট ভরে
গরুর পানে চায় না ফিরে
গরু না পায় ঘাস পানি
ফলন নাই তার হয়রানি
খনা ডেকে বলে যান
খনা ডেকে বলে যান
রোদে ধান ছায়ায় পান
গাছগাছালি ঘন সবে না
গাছগাছালি ঘন সবে না
গাছ হবে তার ফল হবে না
হাত বিশ করি ফাঁক
হাত বিশ করি ফাঁক
আম কাঁঠাল পুঁতে রাখ
বিশ হাত করি ফাঁক
বিশ হাত করি ফাঁক,
আম কাঁঠাল পুঁতে রাখ।
গাছ গাছি ঘন রোবে না,
ফল তাতে ফলবে না।
যদি না হয় আগনে বৃষ্টি
যদি না হয় আগনে বৃষ্টি
তবে না হয় কাঁঠালের সৃষ্টি
যদি না হয় আগনে পানি
যদি না হয় আগনে পানি,
কাঁঠাল হয় টানাটানি।
যত জ্বালে ব্যঞ্জন মিষ্ট
যত জ্বালে ব্যঞ্জন মিষ্ট
তত জ্বালে ভাত নষ্ট
যে না শোনে খনার বচন
যে না শোনে খনার বচন
সংসারে তার চির পচন৷
শোনরে বাপু চাষার পো
শোনরে বাপু চাষার পো
সুপারী বাগে মান্দার রো৷
মান্দার পাতা পচলে গোড়ায়
ফড়ফড়াইয়া ফল বাড়ায়৷
মঙ্গলে ঊষা বুধে পা
মঙ্গলে ঊষা বুধে পা
যথা ইচ্ছা তথা যা।
চাষী আর চষা মাটি
চাষী আর চষা মাটি
এ দু'য়ে হয় দেশ খাঁটি।
গাছে গাছে আগুন জ্বলে
গাছে গাছে আগুন জ্বলে
বৃষ্টি হবে খনায় বলে।
জ্যৈষ্ঠে খরা, আষাঢ়ে ভরা
জ্যৈষ্ঠে খরা, আষাঢ়ে ভরা
শস্যের ভার সহে না ধরা।
আষাঢ় মাসে বান্ধে আইল
আষাঢ় মাসে বান্ধে আইল
তবে খায় বহু শাইল।
আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো
আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো
ধান লাগাও যত পারো।
তিন শাওনে পান
তিন শাওনে পান
এক আশ্বিনে ধান।
পটল বুনলে ফাগুনে
পটল বুনলে ফাগুনে
ফলন বাড়ে দ্বিগুণে।
ফাগুনে আগুন
ফাগুনে আগুন, চৈতে মাট
বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি।
ভাদ্রের চারি, আশ্বিনের চারি
ভাদ্রের চারি, আশ্বিনের চারি
কলাই করি যত পারি।
লাঙ্গলে না খুঁড়লে মাটি
লাঙ্গলে না খুঁড়লে মাটি,
মই না দিলে পরিপাটি
ফসল হয় না কান্নাকাটি।
সবলা গরু সুজন পুত
সবলা গরু সুজন পুত
রাখতে পারে খেতের জুত।
গরু-জরু-ক্ষেত-পুতা
গরু-জরু-ক্ষেত-পুতা
চাষীর বেটার মূল সুতা।
সবল গরু, গভীর চাষ
সবল গরু, গভীর চাষ
তাতে পুরে চাষার আশ।
শোন শোন চাষি ভাই
শোন শোন চাষি ভাই
সার না দিলে ফসল নাই।
হালে নড়বড়, দুধে পানি
হালে নড়বড়, দুধে পানি
লক্ষ্মী বলে চাড়লাম আমি।
রোদে ধান, ছায়ায় পান
রোদে ধান, ছায়ায় পান।
আগে বাঁধবে আইল
আগে বাঁধবে আইল
তবে রুবে শাইল।
গাছ-গাছালি ঘন রোবে না
গাছ-গাছালি ঘন রোবে না
গাছ হবে তাতে ফল হবে না।
খরা ভুয়ে ঢালবি জল
খরা ভুয়ে ঢালবি জল
সারাবছর পাবি ফল।
ষোল চাষে মূলা
ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা
তার অর্ধেক ধান, তার অর্ধেক পান,
খনার বচন, মিথ্যা হয় না কদাচন।
ডাঙ্গা নিড়ান বান্ধন আলি
ডাঙ্গা নিড়ান বান্ধন আলি
তাতে দিও নানা শালি।
কাঁচা রোপা শুকায়
কাঁচা রোপা শুকায়
ভুঁইয়ে ধান ভুঁইয়ে লুটায়।
বার পুত, তের নাতি
বার পুত, তের নাতি
তবে কর কুশার ক্ষেতি।
তাল বাড়ে ঝোঁপে
তাল বাড়ে ঝোঁপে
খেজুর বাড়ে কোপে।
গাজর, গন্ধি, সুরী
গাজর, গন্ধি, সুরী
তিন বোধে দূরী।
খনা বলে শোনভাই
খনা বলে শোনভাই
তুলায় তুলা অধিক পাই।
ঘন সরিষা পাতলা রাই
ঘন সরিষা পাতলা রাই
নেংগে নেংগে কার্পাস পাই।
বারো মাসে বারো ফল
বারো মাসে বারো ফল
না খেলে যায় রসাতল।
ফল খেয়ে জল খায়
ফল খেয়ে জল খায়
জম বলে আয় আয়।
কলা-রুয়ে কেটো না পাত
কলা-রুয়ে কেটো না পাত,
তাতে কাপড় তাতেই ভাত।
চাষে মুলা তার
চাষে মুলা তার
অর্ধেক তুলা তার
অর্ধেক ধান
বিনা চাষে পান
বিপদে পড় নহে ভয়
বিপদে পড় নহে ভয়
অভিজ্ঞতায় হবে জয়
উত্তর দুয়ারি ঘরের রাজা
উত্তর দুয়ারি ঘরের রাজা
দক্ষিণ দুয়ারি তাহার প্রজা।
পূর্ব দুয়ারির খাজনা নাই
পশ্চিম দুয়ারির মুখে ছাই।।
কপালে নাই ঘি
কপালে নাই ঘি,
ঠকঠকালে হবে কি!
নিজের বেলায় আটিঁগাটি
নিজের বেলায় আটিঁগাটি,
পরের বেলায় চিমটি কাটি।
পুকুরে তে পানি নাই
পুকুরে তে পানি নাই, পাতা কেনো ভাসে
যার কথা মনে করি সেই কেনো হাসে ?
ভাত দেবার মুরোদ নাই
ভাত দেবার মুরোদ নাই,
কিল দেবার গোসাঁই।
নদীর জল ঘোলাও ভালো
নদীর জল ঘোলাও ভালো,
জাতের মেয়ে কালোও ভালো
খাঁদা নাকে আবার নথ
খাঁদা নাকে আবার নথ!
থাক দুখ পিতে
থাক দুখ পিতে,(পিত্তে)
ঢালমু দুখ মাঘ মাসের শীতে।
কি কর শ্বশুর মিছে খেটে
কি কর শ্বশুর মিছে খেটে
ফাল্গুনে এঁটে পোত কেটে
বেড়ে যাবে ঝাড়কি ঝাড়
কলা বইতে ভাংগে ঘাড়।
ভাদরে করে কলা রোপন
ভাদরে করে কলা রোপন
স্ববংশে মরিল রাবণ।
গো নারিকেল নেড়ে রো
গো নারিকেল নেড়ে রো
আমা টুকরা কাঁঠাল ভো।
সুপারীতে গোবর
সুপারীতে গোবর, বাশে মাটি
অফলা নারিকেল শিকর কাটি
খনা বলে শুনে যাও
খনা বলে শুনে যাও
নারিকেল মুলে চিটা দাও
গাছ হয় তাজা মোটা
তাড়াতাড়ি ধরে গোটা।
ডাক ছেড়ে বলে রাবণ
ডাক ছেড়ে বলে রাবণ
কলা রোবে আষাঢ় শ্রাবণ।
পূর্ব আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়
পূর্ব আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়
সেই বৎসর বন্যা হয়।
মংগলে উষা বুধে পা
মংগলে উষা বুধে পা
যথা ইচ্ছা তথা যা।
পুত্র ভাগ্যে যশ
পুত্র ভাগ্যে যশ
কন্যা ভাগ্যে লক্ষী
উঠান ভরা লাউ শসা
উঠান ভরা লাউ শসা
ঘরে তার লক্ষীর দশা
বামুন বাদল বান
বামুন বাদল বান
দক্ষিণা পেলেই যান।
বেঙ ডাকে ঘন ঘন
বেঙ ডাকে ঘন ঘন
শীঘ্র হবে বৃষ্টি জান।
আউশ ধানের চাষ
আউশ ধানের চাষ
লাগে তিন মাস।
যদি বর্ষে গাল্গুনে
যদি বর্ষে গাল্গুনে
চিনা কাউন দ্বিগুনে।
যদি হয় চৈতে বৃষ্টি
যদি হয় চৈতে বৃষ্টি
তবে হবে ধানের সৃষ্টি।
চালায় চালায় কুমুড় পাতা
চালায় চালায় কুমুড় পাতা
লক্ষ্মী বলেন আছি তথা।
তথ্যসূত্র:1. মুক্ত বিশ্বকোষ2. khona.blog.com3. prothom-aloblog.com4. বাংলাপিডিয়ায় খনাBlog Link: rajatdmc.blogspot.com
No comments:
Post a Comment