আমিনবাজার হত্যাকাণ্ড |
শবে বরাতের রাতে রাজধানীর আমিনবাজারে নিহত ছয় ছাত্র নির্দোষ। তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো প্রমাণ পায়নি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম এ কে এম এনামুল হক। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তদন্ত কমিটির প্রধান মহানগর হাকিম উৎপল চৌধুরী।
ঘটনার পর পুলিশের করা মামলায় বলা হয়, ডাকাত সন্দেহে ওই ছয় ছাত্রকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগীয় তদন্তে এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ছাত্ররা সেদিন রাতে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে গিয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার এ কে এম সামছুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের পর তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হবে। প্রধান বিচারপতির অনুমোদন-সাপেক্ষে প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে পাঠানো হবে।
হাইকোর্টের নির্দেশে ১০ আগস্ট এক সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১১ জন পুলিশ, নিহতদের পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীসহ ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। ২০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান উৎপল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, এ প্রতিবেদনে সার্বিক পরিস্থিতি উঠে এসেছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিহত ছয় ছাত্র ওই দিন কোনো অপরাধে জড়িত ছিল না বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ওই ঘটনায় দায়িত্ব পালনে পুলিশের গাফিলতি ছিল বলেও উল্লেখ রয়েছে।
এমনকি ঘটনার পর পুলিশের করা মামলায় ‘গণপিটুনি দিয়ে অজ্ঞাতনামা ডাকাত মারার’ অভিযোগে এজাহারে তথ্যগত ত্রুটিও তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বলে একটি সূত্র জানায়।
এই ঘটনায় পুলিশের করা তদন্ত কমিটির কাজও শেষ পর্যায়ে বলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। এই তদন্তেও পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
এ ছাড়া ওই ঘটনায় সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। মামলা দুটি এখন সিআইডি তদন্ত করছে। এই তদন্তে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঘটনার পর পুলিশ সাভার থানায় একটি মামলা করে। এই মামলার ক্ষেত্রে যথাযথ আইন অনুসরণ করা হয়নি এবং নিহতদের পরিবার থেকে মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এ ছাড়া তদন্তকালে স্থানীয় সাক্ষীরা বলেছেন, ঘটনাস্থল দীর্ঘদিন ধরে একটি মাদক ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। তবে ওই ছয় ছাত্র বেড়ানোর উদ্দেশ্যেই বড়দেশী গ্রামে গিয়েছিল। তবে তারা মাদক সেবন করতে গিয়েছিল কি না, সে ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়নি।
গত ১৭ জুলাই রাতে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে শামস রহিম ওরফে শাম্মাম, ইব্রাহিম খলিল, টিপু সুলতান, তৌহিদুর রহমান পলাশ, কামরুজ্জামান কান্ত ও মনিব সেতাবকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তারা প্রত্যেকেই রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র। এই ঘটনায় আল-আমিন নামের এক তরুণ প্রাণে বেঁচে যায়। আল-আমিন জানায়, শবেবরাতের রাতে তারা সাত বন্ধু একসঙ্গে নামাজ পড়তে বের হয়। পরে তারা বেড়াতে আমিনবাজারের যায়।
এই ঘটনায় আইনজীবী তাজুল ইসলামের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত ৩ আগস্ট এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
তাজুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্তে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে বলে শুনেছি। অবকাশকালীন ছুটি শেষে সুপ্রিম কোর্ট খোলার পর দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করা হবে।’
পুলিশের তদন্ত কমিটি: ছয় ছাত্র পিটিয়ে হত্যার পর পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আমির হোসেনকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তদন্তেও পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে ছয় ছাত্র এভাবে প্রাণ হারাত না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের তদন্ত শেষ পর্যায়ে। খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আরও পর্যালোচনা করে আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হতে পারে বলে তিনি আশাবাদী।
হত্যা মামলার অবস্থা: ছয় ছাত্র পিটিয়ে হত্যার পর সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে ‘গণপিটুনি দিয়ে অজ্ঞাতনামা ডাকাত’ মারার অভিযোগে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করে। অপর মামলাটি করে ওই এলাকার বালুর ব্যবসায়ী আবদুল মালেক। তাঁর করা মামলা বলা হয়, ডাকাতেরা ট্রলারযোগে এসে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে এই ব্যবসায়ীকে দিয়ে পুলিশ মামলাটি করিয়েছে।
মামলা দুটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মামলা দুটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছু বলা যাবে না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নিহতদের সম্পর্কে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, তারা ডাকাত। তবে নিহতদের পরিবার বলছেন, তারা ছয়জনই ছাত্র। ছাত্র হলেই যে সবাই ভালো হবে সেটাও ঠিক নয়।’
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই ছয়জন সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। তদন্ত শেষ হতে সময় লাগবে। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।
No comments:
Post a Comment