ঢোল একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। মধ্যযুগের বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যেও ঢোলের উল্লেখ পাওয়া যায়। পয়লা বৈশাখের লাঠিখেলা, হোলি খেলা, নৌকাবাইচ, কুস্তি, কবিগানের আসর, জারিগান, সারিগান, টপ্পাগান, আলকাপ গান, গম্ভীরা, ছোকরা নাচ, গাজনের গান, বাউলগান, মহররমের শোভাযাত্রা, যাত্রাগান, বিয়ের বরযাত্রা ইত্যাদিতে ঢোল বাজে। হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা ঢোল ছাড়া চলেই না। বিশেষ করে দুর্গাপূজা ও কালীপূজায় ঢোল বাজানো হয়। কয়েক বছর আগেও সরকারি কোনো আদেশ বা পরোয়ানা ঢোল বা ঢেড়া পিটিয়ে বিভিন্ন হাটে-বাজারে ঘোষণা করা হতো। ঢোলের আওয়াজ বহু দূর থেকে শ্রুত হয়।
ঢোল আর ঢাক অভিন্ন নয়। ঢোল ঢাকের চেয়ে ছোট। কিন্তু উভয় বাদ্যযন্ত্রেরই দুই প্রান্ত চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে। ঢাক বাজানো হয় দু’টি কাঠি দিয়ে একই প্রান্তে। বাংলা ঢোল নামে আরেকটি বাদ্যযন্ত্র আছে। বাংলা ঢোলের আকার সাধারণ ঢোলের চেয়ে বড়। বাংলা ঢোলের আওয়াজ সাধারণ ঢোলের চেয়ে গম্ভীর। এছাড়াঢোলের চেয়ে ছোট আরেকটি বাদ্যযন্ত্র আছে, যার নাম ঢোলক। ঢোলক দেখতে একটি ছোট পিপার মতো। ঢোলকের দু’দিকের ব্যাস সমান, ঢেকে রাখা চামড়া তুলনামূলকভাবে পাতলা। ঢোলক বাজাতে কোনো কাঠি লাগে না, হাত দিয়েই বাজানো হয়। ঢোলক বেশি ব্যবহৃত হয় নাটক ও যাত্রাপালায়। গজল ও কাওয়ালী গানে ঢোলক এক অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র। ঢোল যে বাজায় তাকে বলে ঢুলি বা ঢোলি। ঢুলিরা সাধারণত ঢোলের দু’দিকে মোটা রশি বা গামছা বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে ঢোল বাজান। ঢোল বাজাতে ডান হাতে একটি কাঠি ব্যবহার করা হয়। বাম হাতের তালু দিয়ে অন্যপ্রান্ত বাজানো হয়। ঢুলিরা ঢোলের ডান দিক কাঠির বাড়িতে এবং একই সঙ্গে হাতের চাঁটিতে বাম দিকে ঢোল বাজিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিনয় বাঁশি ভারত উপমহাদেশের একজন সেরা ঢোলবাদক। একটি খোদাই করা কাঠের উভয় দিক চামড়া দিয়ে ঢেকে এই ঢোল তৈরি করা হয়। ঢোল পিপার মতো একটা কাঠের খোলবিশেষ, যার দুই মুখ খোলা, ভেতরটা ফাঁপা। দু’দিকে চামড়া দিয়ে আচ্ছাদন দেয়া। একমুখে থাকে গরু বা মহিষের মোটা চামড়া, অন্যপ্রান্তে থাকে ছাগলের পাতলা চামড়া। এতে মোটা ও চিকন শব্দে তালে তালে ঢোল বাজে। ঢোলের খোলটির পিঠে দড়ির টানা থাকে। এই টানাতে পিতলের কড়া লাগানো থাকে। কড়া সামনে বা পেছনে টেনে ঢোলের সুর বাধা হয়। ঢোলের খোলটা মাঝখানে একটু মোটা, দুই প্রান্ত একটু সরু।
বরিশালে দুর্গা পুজায় ঢাক তৈরির শ্রমিকেরা ব্যস্ত:
ঢাকের তালে জীবন চলে..আজি বাজা কাসর..জমা আসর, আজবেরে মা আসবেরে....বলো দূর্গা মায় কি...জয়....." শারদীয় দুর্গা পুজোর উৎসবের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে ঢাক। পুজোর সময় সন্ধ্যা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকের বাদ্যে মুখরিত হয়ে ওঠে দুর্গা মন্দিরের আশপাশসহ পাশর্্ববর্তী এলাকা। সন্ধ্যা শেষে মধ্যরাতে ঢাকের শব্দ শুনলেই বোঝা যায় মন্দিরের সম্মুখে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরম্ন হয়ে গেছে। তাই ঢাকের শব্দ শুনেই ধর্মবর্ণ নিবিশেষে অনুষ্ঠান প্রেমীরা দলবেঁধে ছুটে চলেন মন্দির আঙ্গিনায়। এছাড়া হিন্দু সমপ্রদায়ের বারো মাসের প্রায় প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিয়ে বাড়িতে ঢাক-ঢোল আর বাঁশির শব্দ এবং ঢুলীদের কোমর ঢোলানো নাচ-ই হচ্ছে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ।
প্রাচীনকাল থেকেই এ ঢাক বাদ্যের প্রথা চলে আসছে। এককথায় ঢাকের বাদ্য (শব্দ) ছাড়া দুর্গা পুজোর অনুষ্ঠানসহ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোন অনুষ্ঠানই জমে না। এছাড়াও অতীতের জমিদারদের পাইক পেয়াদারা ঢাক পিটিয়ে (বাজিয়ে) প্রজাদের মধ্যে জমিদারদের হুকুম জারি কিংবা নিমন্ত্রন করতেন।
যুগ যুগ ধরে ঢাক বাদ্য তৈরি ও ঢাক বাজিয়ে অনেক মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বর্তমান আধুনিকতার যুগও প্রাচীনকালের ঢাকের প্রথাকে আজো বিলুপ্তি ঘটাতে পারেনি। বিশেষ করে দুর্গা পুজো আসলেই ঢাকের চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই ঢাক তৈরির কারিগর ও শ্রমিকেরা এখন মহাব্যসত্ম সময় কাটাচ্ছেন। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ও সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পুজো উপলক্ষে ঢাক বাজানো বাদ্যকার ও বিভিন্ন মিউজিক পার্টি থেকে অর্ডার নেয়া ঢাক সঠিক সময়ে সরবরাহ করার জন্য ঢাক তৈরির কারিগর ও শ্রমিকদের এখন দিনরাত এককার হয়ে গেছে।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের ঢাক তৈরির কারিগর শ্যামল দাস (৫০)। বংশ পরম্পরায় দীর্ঘ ৩০ বছর পর্যনত্ম তিনি এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তার জন্মস্থান মানিকগঞ্জে। শ্যামল দাস জানান, তার পূর্ব পুরম্নষ ঢাকসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজ করেছেন। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে কাজ শিখেছেন। তার শ্বশুর বরিশাল বিভাগের একমাত্র হিন্দু অধু্যষিত আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরে দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করেছেন। সে হিসেবে তিনি (শ্যামল) গত ২০ বছর ধরে আগৈলঝাড়ায় স্থায়ী দোকান দিয়ে এ কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, একটি মাঝারি ঢাক তৈরি করতে তার ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হয়। আর সেটি বিক্রি করছেন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকায়। হিন্দু অধু্যষিত আগৈলঝাড়া বারো মাসই তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। দুর্গা পুজো উপলক্ষে ইতোমধ্যে তার কাছে নতুন ঢাক তৈরি ও মেরামতের বেশ অর্ডার এসেছে। পাঁচ সদস্যের সংসারে ঢাকসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামত করে শ্যামল দাস তার পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দেই বসবাস করছেন। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া গ্রামের মুনিদাশ পাড়াকে সবাই ঢাক-ঢোল পাড়া হিসেবেই চেনে। মুনিদাশ পাড়ার সবার ব্যস্ত সময় কাটে ঢাক, ঢোল, ডুগি, তবলা আর কঙ্গ তৈরির কাজে। সেখানে অলস বসে না থেকে ছোট-বড় সবাই কোনও না কোনও কাজ করেন। এখানে নারীরাও আছেন সহযোগীর ভূমিকায়। তারা বানান ডুগি-তবলার বিড়া। গৃহস্থালির কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তারা লেগে যান পুরুষদের সাথে। দিন-রাত চলে বিরামহীন কাজ। বসে থাকার কোনও জো নেই। আর পূজা এলে তো কথাই নেই। ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহু গুণ। খাওয়া-নাওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না।
মনিদাশ পাড়ার শতবর্ষী খগেন্দ্র দাশের সাথে কথা বলে জানা যায়, মনিদাশ পাড়ায় প্রায় ২৫টি পরিবার এই ঢাক-ঢোল বানানোর কাজে জড়িত । কেউ পৈতৃক পেশা হিসেবে, আবার কেউ শখ করে এই কাজ করে থাকেন। এখানে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এই কাজ করা হচ্চে। ঘিওরের এই মুনিদাশ পাড়ায় আর মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায় ২-৩টি পরিবার এই কাজের সাথে জড়িত।
পাড়ার আরেক প্রবীণ ব্যক্তি খোকা রাম (৮০) জানান, মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরে শ্রীকান্ত বাবু নামের এক লোকের কাছ থেকে আমরা কয়েকজন এই কাজটি শিখেছিলাম। পরে অনেকেই এই কাজের সাথে জড়িত হয়েছেন। পাড়ার সবাই এই কাজ করেই সংসার চালান। এখানে পাইকারি এবং খুচরা বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করা হয়। ঢাকার বড় বড় বাদ্যযন্ত্রের শোরুমে এমনকি বিদেশ থেকেও অর্ডার আসে এখানে।
বকুল চন্দ্র দাশ (৪৫) জানান, আমি প্রায় ২০ বছর ধরে এই কাজের সাথে জড়িত। বাদ্যযন্ত্র বানাতে আমরা আম, নিম, রেন্ডিকড়ই, শিমুল কাঠ ব্যবহার করে থাকি। এখানে আমরা ঢাক, ঢোল, ডুগি, তবলা, কঙ্গ ও বাচ্চাদের ঢোল তৈরি করে থাকি। এখানে কাঠ ও আকারভেদে বাদ্যযন্ত্রের দাম বিভিন্ন রকমের। তবে একটি ঢাক ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা, তবলা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়ে থাকে। একেকটি যন্ত্র তৈরি করতে প্রায় ৪-৫ দিন লেগে যায়। ক্রেতারা যেভাবে অর্ডার দেন আমরা সেভাবেই কাজ করে দিই।
নারায়ণ চন্দ্র দাশ (৪৪) জানান, আমাদের তৈরি বাদ্যযন্ত্র ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জায়গায় যায়। এ বছর আমরা ঢোলের সবচেয়ে বড় অর্ডার পেয়েছি রামপুরার বাংলাদেশ তাল তরঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা এমনকি দেশের বাইরেও ঘিওরের মুনিদাশ পাড়ার বাদ্যযন্ত্রের অনেক সুনাম আছে। পরিশ্রম বেশি, তবে লাভ খুব একটা না-- এমনটাই জানালেন ঢাকঢোল পাড়ার বাসিন্দারা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়তো এ শিল্পটি আরো সমৃদ্ধ হবে এমনটিই প্রত্যাশা তাদের।
তথ্যসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া
২। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি
৩। দৈনিক জনকণ্ঠ
No comments:
Post a Comment