লকারবিতে বিধ্বস্ত প্যান-অ্যাম ফ্লাইট ১০৩ |
( এটা নিয়ে ইংরেজিতে নোট লিখেছিলাম। আজ বাংলাতে লিখছি। কারণ মাতৃভাষার উপর কোন কিছুই বড় নয়। )
পূর্বকথাঃ ১৯৮১ সালের ১৯ অাগস্ট সিদরা উপসাগরে মার্কিন প্রশিক্ষণরত বিমানের উপর ২ টি লিবিয়ান যুদ্ধবিমান হামলা করে। আমেরিকানরা পাল্টা হামলা করে লিবিয়ার যুদ্ধবিমান দুটিকে ধ্বংস করে দেয়। ১৯৮১ এর ডিসেম্বরে আমেরিকা তাদের সকল নাগরিককে লিবিয়া ত্যাগের নির্দেশ দেয়। ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল পচ্চিম জার্মানির বার্লিনে মার্কিন বার La Belle discothèque বোমা হামলা চালানো হয়। ৩ জন নিহত হন এবং ২৩০ জন আহত হন যার ভিতর ৭৫ জন আমেরিকান। আমেরিকান গোয়েন্দারা পূর্ব জার্মানিতে লিবিয়ান দূতাবাসের একটি কোডেড মেসেজ ধরে ফেলে। লিবিয়া থেকে পূর্ব জার্মানিতে লিবিয়ান দূতাবাসে এই হামলার জন্য তাদের অভিনন্দন জানানো হয়।
২০০৩ এ বার্লিন হামলার জন্য লিবিয়া জার্মানিকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়।
আমেরিকা ক্ষেপে যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান লিবিয়াতে হামলার নির্দেশ দেন।
১৯৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল। ব্রিটেনের মাটি ব্যবহার করে ৬৬ টি মার্কিন যুদ্ধবিমান উড়ে যায়। ফ্রান্স, স্পেন এবং ইতালি তাদের আকাশ ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ১২ মিনিটের হামলায় গাদ্দাফির ৩ বছরের পালিত কন্যা হান্না গাদ্দাফি সহ ৪৫ জন নিহত হয়। ২০০০ এর উপর লিবিয়ান আহত হন। আমেরিকানরা ১ টি এফ ১১১ বিমান ও ২ জন পাইলট হারায়।
শিল্পীর চোখে সিদরা উপসাগরে লিবিয়ান যুদ্ধবিমান মার্কিন বিমানের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্ত |
রোনাল্ড রিগান বলেন, "When our citizens are attacked or abused anywhere in the world on the direct orders of hostile regimes, we will respond so long as I'm in this office."
গাদ্দাফি ক্ষেপে যান। তিনি জানতেন ব্রিটেন আমেরিকাকে তাদের ভুমি ব্যবহার করে লিবিয়াতে হামলা চালাতে দিয়েছে। তিনি প্রতিশোধ নিতে চাইলেন।
লকারবি হামলাঃ
১৯৮৮ সালের ২১শে ডিসেম্বর। সন্ধ্যার কিছু পরে দক্ষিন স্কটল্যান্ডের লকারবি শহরের উপর মাঝ আকাশে ভেঙে পড়লো একটি বিমান। প্যান-অ্যাম ফ্লাইট ১০৩ এর বোয়িং ৭৪৭-১২১ বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে নিউ ইয়র্কের কেনেডি বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিলো। মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হলো বিমানটি। নিহত হলেন ২৪৩ জন যাত্রী ও আরো ১৬ জন ক্রুর সকলে। বিধ্বস্ত বিমান শহরের বাড়িঘরের উপর পড়লে আরো ১১ মানুষ মারা যান। দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭০ জনে।
গ্রীনিচ সময় ১৯.০১ এ ফ্লাইট ১০৩ সলওয়ে ফার্থের কোনায় পৌঁছায়। তার উপকূল অতিক্রম করে ১৯.০২ এ। রাডারে এ সময় ট্রান্সপন্ডার কোড (প্রতিটি বিমানকে রাডারে আলাদা ভাবে চেনার বিশেষ কোড) সেট করা হয়। বিমানটির ফ্লাইট লেভেল এ সময়ে ছিলো ৩১০ বা ৯,৪০০ মিটার। গতি ছিলো ৪৩৪ নট বা ৮০৪ কিঃমিঃ/ঘন্টা।
আবদেলবাসেত আল-মেগ্রাহি |
এসময় হঠাৎ বিমানটি আকস্মিক রাডার থেকে উধাও হয়ে যায়। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমানের ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোন উত্তর আসেনি। কন্ট্রোলটাওয়ার সে সময় নিকটে উড্ডয়নরত কেএলএম এর ফ্লাইটকে বিমানটির সাথে যোগাযোগের জন্য বলে। কিন্তু কেএলএমও বিমানটি থেকে কোন সাড়া পায়নি। গ্লাসগো থেকে লন্ডন অভিমুখী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পাইলট ক্যাপ্টেন রবিন চেম্বারলিন স্কটিশ কর্তৃপক্ষকে জানান তিনি মাটিতে একটি বিশাল অগ্নিকুন্ড দেখতে পেয়েছেন।
বিমানটি মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে নীচে পড়ে যায়। মাঝ আকাশেই বিস্ফোরিত হওয়ায় বিমানটির অসংখ্য টুকরো বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলে এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে ভেঙে পড়া অংশগুলো উদ্ধার ও সেগুলোকে যথাস্থানে রেখে বিমানটির বিধ্বস্ত হবার কারণ খোঁজা।
বিস্ফোরণের ফলে বিমানটির ফিসেলজ বা মূল কাঠামোর যে স্থানে লেখা ছিলো "প্যান অ্যাম" সেখানে 'পি' এর নীচে ২০ ইঞ্চির মত একটি গর্তের সৃষ্টি হয়। আমেরিকার ফেডারাল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) ককপিটের ভেঙে পড়া অংশ উদ্ধারের পর দেখতে পান ফ্লাইট ক্রুদের দেহ তাদের আসনে বসা অবস্থাতেই আছে। যা ইঙ্গিত করছে কোন জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হয়নি ফলে জরুরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চাপ নিয়ন্ত্রক এবং ফুয়েল সুইচ স্বাভাবিক ভাবে চলার অংশেই আছে, আর ক্রুরা অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করেননি। বিমান যদি দ্রুত চাপ হারিয়ে ফেলে তাহলে পাঁচ সেকেন্ডের ভেতর এই মাস্ক ব্যবহার করা জরুরী। বৃটিশ তদন্তকারীরা সিদ্ধান্ত দেন বিস্ফোরণের তিন সেকেন্ডের মধ্যে ককপিটের অংশটি মূল বিমান থেকে খসে পড়ে।
বিমানের ককপিট ভয়েস রেকর্ডারটি বিমানের লেজের দিকে অবস্থিত। বিস্ফোরণের ২৪ ঘন্টা পর তা উদ্ধার করা হয়। সেখানে কোন রকম বিপদবার্তার কথা শোনা যায়নি। ১৮০ মিলিসেকেন্ড সময়ে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়, এরপর বিস্ফোরণের কারণে সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তদন্তকারীরা জানান ককপিট খসে পড়ার পর বিমানটি এলোমেলো ভাবে ঘুরে ঘুরে মাটির দিকে নিক্ষিপ্ত হয়।
বিস্ফোরণের শক ওয়েভ বিমানের মাঝ বরাবর প্রবাহিত হয়ে লম্বালম্বি ভাবে বিমানটিকে ভেঙে ফেলে। ইঞ্জিন ও অন্যান্য অংশ খুলে পড়ার পর বিমানটি সোজা নীচের দিকে পড়তে থাকে। কেবিনের চাপ দ্রুতই কমে যাওয়ায় যাত্রীদের দেহ স্বাভাবিকের চাইতে চারগুন প্রসারিত হয়। ফলে তাদের ফুসফুস ফুলে ওঠে এবং তারপর ফেটে যায়। টর্নেডোর মত ঝড়ো বাতাস সরাসরি যাত্রীদের বুকে লাগে এবং শ্বাস নেয়া এ সময় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেকেই পেছনের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। বাইরের তাপমাত্রা এ সময় ছিলো -৪৬ সেন্টিগ্রেড। অনেককেই সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানটি নীচে নেমে আসলে তখনো বেঁচে থাকা যাত্রীদের পক্ষে শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা সহজতর হয় এবং কেউ কেউ সম্ভবত বিমানটি মাটিতে আঘাতের সময়েও বেঁচে ছিলেন। উদ্ধারের সাথে সংশ্লিষ্ট এক হেলিকপ্টার পাইলট বলেছেন তিনি একটি মৃতদেহের হাতে ঘাস ধরা অবস্থায় দেখেছেন।
স্থানীয় এক স্কটিশ চাষী বলেছিলেন তার বাড়ির উঠোনে এসে পড়া জনৈক যাত্রী বেঁচে ছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে নেবার আগেই তার মৃত্যু হয়।
তদন্তঃ
তদন্তে বিস্ফোরকের আলামত থেকে থেকে স্পষ্ট হয় যে বোমার আঘাতেই বিমানটিকে উড়িয়ে দেয়া হয়। যে স্যুটকেস থেকে বোমা বিস্ফোরণটি ঘটে তার ভেতর তোশিবা বোমবিট রেডিও ক্যাসেট প্লেয়ারের একটি ছোট্ট সার্কিট ও শিশুদের জামা পাওয়া যায়। জামাটি মাল্টার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করার প্রমান মেলে। সেই প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা যায় লিবিয়ান চেহারার একজন ঐ পোষাকটি ক্রয় করে। বিস্তারিত তদন্তে লিবিয়ান নাগরিক সাবেক ইন্টেলিজেন্স অফিসার আবদেলবাসেত আল-মেগ্রাহি'র নাম বেরিয়ে আসে।
২০০০ সালে অনুষ্ঠিত বিচারে মেগ্রাহির কমপক্ষে ২০ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়। মেগ্রাহি দীর্ঘদিন লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির আশ্রয় ছিলেন। পরে প্রবল পশ্চিমা চাপে তাকে স্কটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হয়। ২০০৯ সালে মেগ্রাহি প্রোস্টেড ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে স্কটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে মানবিক বিবেচনায় মুক্তি দেন।
২০১১ এর ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিজেই লকারবির আকাশে বিধ্বস্ত প্যান অ্যামের যাত্রীবাহী বিমানে বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন দেশটির সাবেক আইন মন্ত্রী মোস্তফা আবদুল জলিল। সুইজারল্যান্ডের ট্যাবলয়েড দৈনিক এক্সপ্রেসকে গতকাল দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ দাবি করেন লিবিয়ার সাবেক আইন মন্ত্রী। আন্দোলনরত জনতার বিরুদ্ধে হামলা চালানোর প্রতিবাদে আবদুল জলিল সম্প্রতি লিবিয়ার আইনমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। লকারবির আকাশে বিধ্বস্ত প্যান অ্যামের যাত্রীবাহী বিমানে বোমা পাতার নির্দেশ গাদ্দাফি দিয়েছিলেন সে প্রমাণ তার কাছে আছে বলে দাবি করেন আব্দুল জলিল। তবে, সুনির্দিষ্টভাবে সে প্রমাণ এ সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেননি তিনি।
এদিকে লকারবি বোমা হামলায় অভিযুক্ত আব্দেল বাসেত আল মেগরাহি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। ত্রিপোলির প্রাসাদোপম ভিলায় তিনি এখন কোমায় আছেন। তাকে কোন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র অক্সিজেন দিয়ে ফেলে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। গতকাল অনলাইন ডেইলি মেইল এ খবর দিয়েছে। বোমা হামলায় যেসব লোকজন মারা গিয়েছেন তাদের পরিবার পরিজনের দাবি, আব্দেল বাসেত আসলে যতটা বলা হয়েছে ততটা অসুস্থ নন। তিনি স্কটল্যান্ডে যাবজ্জীবন জেলের মাত্র ৮ বছর সাজা খেটেছেন। তারপরই স্কটল্যান্ডের আইনমন্ত্রী কেনি ম্যাকআসকিল তাকে মুক্তি দেন। এটা সরকারের বড় একটি ভুল। ওদিকে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের রাজনীতিকরা তাকে ফেরত দিতে বলছে, যাতে তিনি বাকি সাজা ভোগ করতে পারেন। তবে বিদ্রোহীদের সরকার ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি) গতকাল বলেছেন, মেগরাহিকে তারা দেশ থেকে বের করে দেবে না। এনটিসির আইনমন্ত্রী মোহাম্মেদ আল আলাগি বলেছেন, আমরা লিবিয়ার কোন নাগরিককে পশ্চিমাদের হাতে তুলে দেব না।
No comments:
Post a Comment